শেখ ভানু

 


শেখ ভানু

(জন্মঃ ১৮৪৯ -মৃত্যু ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ) - (বাংলা - ১২৫৮ - ১৩২৬)। বাংলাদেশের একজন মরমী সাধক ও বাউল গানের কবি। তার লিখা গানের সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি। শেখ ভানুর গানের মধ্যে জনপ্রিয় অন্যতম গান হচ্ছে; (১) আমি পাড়লাম না-রে - আমার মনকে বুঝাইতে, তোমরানি দেইকাছো কেউ - কদম তলায় ফুল ফুইঠাছে (২) নিশিতে যাইও ফুল বনে-রে ভ্রমরা - নিশিতে যাইয় ফুল বনে।[১] ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে মনসুর উদ্দীন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কয়েক হাজার বাউল গান সংগ্রহ করে হারামণি ম্যাগাজিনে ১৯৪২ প্রচার করেন। শেখ ভানুর অনেকটি গান উক্ত ম্যাগাজিনে অন্তর্ভক্ত হয়েছে বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।
শেখ ভানু সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলার ভাদিকারা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মুন্সি নাছির উদ্দীন। তিনি একজন মুনশী ছিলেন ।শেখ ভানু তার স্বরচিত পুঁথি গ্রন্থের এক অন্তরায় পিতৃ পরিচয় এভাবে ধরে তুলেছেনঃ
“(শেখ) নছর উদ্দীন পিতার -- করিতেন শরার কাম,
মুনশীয়ানা ছিল লিয়াকত।
আমি যে অধম ভাই - - আল্লার কাছে পানাহ চাই
আখেরে থাকিতে ছালামত। ”
এছাড়া শেখ ভানু সুফীবাদের শিক্ষা লইতে বাগদাদ হতে বাংলাদেশে আগত দরবেশ মীরাণ শাহের শিশত্ব গ্রহণ করেছিলেন। যার বয়ান আশরারুল এশক গ্রন্থে তিনি ত্রিপদি ছন্দে উল্লেখ্য করেছেন;
“মুর্শিদ মোর মীরাণ শাহা - - মরি মরি আহা আহা
কি কহিমু গুণের বাখানী।
বড়পীর বোগদাদেরই --বহুত দিন খাদেম করি
দেশে দেশে করিলেন ছফর।
(একদিন) গরিব খানাতে আসি -- জাগিয়া পোহাইলেন নিশি
নছিয়ত করিলেন বহুতর ।
মুরিদ করিয়া মোরে -- চলিয়া গেলেন ঘরে
রাখিয়া আমারে একাশ্বর ।
দেশে দেশে আছে জারী -- তাতার মুল্লুক হয় বাড়ী
জন্ম আদি সৈয়দ খান্দান। ”
শেখ ভানু ছিলেন ধানের বেপারী। তিনি গ্রাম অঞ্চল থেকে ধান ক্রয় করে ভৈরব, মদনঞ্জ মোহনগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় বিক্রি করতেন। ব্যবসার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে আসা যাওয়া করার পথে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করে তিনি ভাবতেন স্তরে স্তরে সাজানো এই সৃষ্টির অনিশ্চয়াতা নিয়ে। শ্রুতির ভিত্তিতে লিখা এমন একটি ঘটনা সৈয়দ মোস্তফা কামাল উল্লেখ করে লিখেনঃ একদিন ভরা বর্ষায় মেঘনা নদী দিয়ে ধানের নৌকা নিয়ে শেখ ভানু বাড়ি ফিরছিলেন । হাঠাৎ জলস্রোতে ভেসে যাওয়া একটি মৃত দেহ তার চোখে পরল। তিনি দেখলেন শবের উপরে বসে একটি কাক লাশের চোখ ঠুকরিয়ে খাচ্ছে। শেখ ভানু মানব দেহের এ পরিণতি দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মনের আবেগে বললেন হায়-রে সোনার তনু - - আখের তোর এই হাল। এভাবে শেখ ভানু সংসারের অনিত্যতা প্রত্যক্ষ করে, দুনিয়ার মোহ, মায়া, লোভ প্রভৃতি ত্যাগ করে আল্লাহর পথে ফকির হয়ে পরমাত্মার সন্ধান করতে থাকেন। এ বিষয়টি শেখ ভান তার নিজের ভাষায় বর্নণা দিয়ে লিখেন;
“এক রোজ বসে আছি নৌকার উপর
পানির মধ্যে দেখিলাম করিয়া নজর
হায়-রে; পানির উপর দেখিলাম করিয়া নজর ।
মুর্দা মানুষ ভাসে এক 'মাঝ দরিয়ায়'
উপরে বসিয়া কাক চক্ষু তার খায়
দেখিয়া আফসোস হইল দিলের ভিতর
কাঁন্দিয়া কইলাম তন-রে কি অইবে তোর।
কোথা রইলা মাতা পিতা ভাই বন্ধুগণ
কোথায় রইল ঘর বাড়ি অঙ্গের বসন
স্ত্রী-পুত্র ছাড়াইয়া কে ভাসাইল তরে
মাছ-মাছলী টাইন্যা খায় পানির উপরে। ”
শেখ ভানুর -নিশীতে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা , নিশীতে যাইও ফুলবনে ।।এই কালজয়ী গানটি দেশে বিদেশে সর্বজনীন জনপ্রিয়তার লাভ করেছে । গানটি পৃথিবীর অনেক ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে ।এই বিখ্যাত গানটির কথা আরো দুজন কবিকে উৎসাহী করেছে বলে অনেক গবেষকদের ধারনা । তাদের দুজনেরই কিছু কথা রদবদল আছে ।এ যেন এক ফুল-তিন মালী ।একটি গান,তিনজন গীতিকারঃশেখ ভানু,রাধারমণ দত্ত,ও জসীম উদ্দীন । শেখ ভানুর লিখিত দুটি বই আছে যা (১) আশরারুল এশক (২) পুথিঁ শেখ ভানু । এ বই গুলো বাজারে নেই । তবে তাকে নিয়ে গবেষকরা গবেষণা করায় তার কাব্য গুলোর অনেকাংশ সংরক্ষণ হয়েছে। এ দার্শনিক কবিকে নিয়ে সৈয়দ মোস্তফা কামাল, দেওয়ান নুরুল আনোয়ার চৌধুরী, ডঃ আসরাফ সিদ্দীকি, মোস্তফা জামান আব্বাসী নন্দলাল শর্মা, তরফদার মোহাম্মদ ইসমাইলের মতো গুনি জনেরা গবেষণা করেছেন। সুফী দার্শনিক কবি শেখ ভানু শিরোনামে একটি গ্রন্থ ২০০৪ সালে প্রকাশ করা হয়।
তথ্যসূত্র-উইকিপিডিয়া

No comments

Powered by Blogger.